Pages

Saturday, July 12, 2014

মাহমুদুর রহমানের কলাম

mamdur-sml.jpg মন্তব্য প্রতিবেদন : গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন মাহমুদুর রহমান চব্বিশটি দিন লন্ডনে চিকিত্সা শেষে গত শুক্রবার দেশে ফিরেছি। ডান চোয়ালের একটা হাড়ে ক্ষয় দেখা দিয়েছিল, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম osteoarthritis। আমার শরীরে হাড়ের বিভিন্ন স্থানে সমস্যা রয়েছে। কোমরে osteoporosis, কাঁধে spondilitis এবং চোয়ালে osteoarthritis। ২০১০ এবং ২০১১ সালে দশ মাসের জেল জীবনের কষ্ট ও চিকিত্সার অভাবে এই সমস্যাগুলো জটিলতর হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার মাস তিনেক বাদেই লক্ষ্য করলাম মুখের ডান দিক দিয়ে খাদ্য চিবুতে কষ্ট হচ্ছে, আনুষঙ্গিক উপসর্গ হিসেবে ডান কানে তীব্র ব্যথা। ঢাকা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ঘোরাঘুরি করে রোগটা ধরা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত লন্ডন যেতেই মনস্থ করলাম। দুর্ভাবনা ছিল শেখ হাসিনার ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার যেতে দেয় কীনা। সংশয় নিয়েই ১০ এপ্রিল বিমানবন্দরে পৌঁছে সোজা চলে গে লাম ওসি’র কক্ষে। সঙ্গের কাগজপত্র ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললাম, ওপর খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে। সস্ত্রীক অপেক্ষা করতে লাগলাম ওসি’র অফিসকক্ষের বাইরে আম যাত্রীদের আসনে বসে। এবার অবশ্য আমার অতিরিক্ত একটা সুবিধা ছিল। যুক্তরাজ্যে যাওয়া এবং সেখান থেকে আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সম্ভবত সেই কাগজের জোরে আধঘণ্টার মধ্যেই ছাড়পত্র মিলল। অবশ্য এ মাসের ৪ তারিখে ফেরার পথে বিমানবন্দরে নতুন বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তবে সে ঘটনা লেখার শেষে বর্ণনা করব। ১৩ তারিখে ডাক্তার পরীক্ষা করে হাড়ের অতিরিক্ত ক্ষয়ের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে অধিকতর পরীক্ষার জন্য CT scan করতে পাঠালেন। পরীক্ষায় ধরা পড়ল, হাড় অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় নেই। ২৩ এপ্রিল অস্ত্রোপচারের আগেই লন্ডনে বসে দুর্মুখ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত বাবুর ঘুষ খাওয়া আর অনুজপ্রতিম রাজনীতিক ইলিয়াস আলীর গুমের দুঃসংবাদ পেলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের রেলমন্ত্রীর ঘুষ নেয়ার সংবাদে মোটেও অবাক হইনি। বরঞ্চ ঘটনাটি আমার কাছে ক্ষমতাসীনদের সাড়ে তিন বছরব্যাপী দুর্নীতির বিশাল হিমশৈলের সামান্য দৃশ্যমান চূড়ার (tip of the iceberg) মতোই ঠেকেছে। সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে আমি কেবল মন্ত্রীর গাড়ি চালক আলী আজমকে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়েছি। সেই গভীর রাতে সে সাহস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিলখানার বিডিআর সদর দফতরের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে চোর মন্ত্রীর সহযোগীদেরসহ বমাল ধরা পড়ার ব্যবস্থা করেছে। কোনো সভ্য রাষ্ট্র হলে আলী আজমকে নিয়ে এতদিনে হৈ চৈ পড়ে যেত। রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করত। কিন্তু, আমাদের হতভাগ্য মাতৃভূমি বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার ঘুণপোকার মতো প্রবেশ করেছে। তাই এই রাষ্ট্রে ক্ষমতাধর প্রতিবেশীর চাপে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী বহাল তবিয়তে থাকেন। জনগণের করের টাকায় নির্লজ্জের মতো বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন। মন্ত্রীর দুর্নীতিলব্ধ অর্থ দিয়ে তার পুত্র বুক ফুলিয়ে টেলিকম লাইসেন্স ক্রয় করে। আর অসীম সাহসী, দরিদ্র গাড়ি চালক গুম হয়ে যায়। এমন নির্যাতক রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। তাই আমি এই ব্যবস্থার অবধারিত ধ্বংস এবং অন্যায় সহ্যকারী, ভীরু জনগণের অনাগত দুঃখ-কষ্টের পানে চেয়ে থাকি। সুরঞ্জিত বাবুদের মতো বহুরূপী, চাপাসর্বস্ব, বিবেক বিবর্জিত রাজনীতিবিদদের নিয়ে লিখে সময় এবং কাগজ নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। এই অসুস্থ শরীরে আমি প্রধানত ইলিয়াস আলীর গুম এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অপকর্মের প্রতিবাদ করতেই কষ্ট করে লেখার টেবিলে বসেছি। এপ্রিলের ১০ তারিখে লন্ডন রওনা হয়েছিলাম। তার মাত্র দিন দুয়েক আগেই ইলিয়াস আমার দেশ কার্যালয়ে গল্প করতে এসেছিল। সময়- সুযোগ পেলেই ইলিয়াস আমার কাছে আসত। বিএনপি’র দলীয় রাজনীতি, ভারতীয় আগ্রাসন, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সেদিনও আমরা দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেছিলাম। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতাটিকে যারা কাছ থেকে চেনেন তাদেরই ওর খানিকটা বেপরোয়া, শিশুসুলভ স্বভাবটিকে জানার কথা। নানা বিষয় নিয়ে হৈচৈ করত, জিয়া পরিবার ব্যতীত দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে বড় একটা তোয়াজ করতে চাইত না। কিন্তু মনটা বড় ভালো, জাতীয়তাবাদী আদর্শের একজন নিখাদ সৈনিক। আমাদের গল্পের মাঝখানে হঠাত্ করে প্রবীণ প্রকৌশলী, পেশাজীবী আন্দোলনে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আনহ আখতার হোসেনও যোগ দিয়েছিলেন। ইলিয়াস তার নানারকম বিপদের আশঙ্কার কথা আমাকে বলেছিল। সাম্রাজ্যবাদী ভারত এবং তাদের পদলেহী ক্ষমতাসীন মহল ইলিয়াস আলীর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে তার বিপুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ছিল। সাইফুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর সিলেটের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী রাজন ীতির যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, ইলিয়াস তা ধীরে ধীরে পূর্ণ করে আনছিল। বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ ও সিলেটবাসীর ব্যানারে ভারতীয় ভূমি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিলেট থেকে জৈন্তাপুর সহস্রাধিক যানবাহন নিয়ে আমরা গত বছর যে বিশাল লংমার্চ করেছিলাম, তার সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছিল ইলিয়াস। আজ ওর অন্তর্ধান নিয়ে লিখতে বসে সেদিনের একটা ঘটনার কথা বড় মনে পড়ছে। আমাদের গাড়িবহর সীমান্তের একেবারে পাশ ঘেঁষে জৈন্তাপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফের ক্যাম্পগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গাড়িবহরের একেবারে মাথায় আমি এবং ইলিয়াস হুড খোলা জিপে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বেশ ধীরেই এগোচ্ছি। এমন সময় ইলিয়াস স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে উঠল— মাহমুদ ভাই, ভারতীয় শাসকশ্রেণীর কাছে আপনি এবং আমি অন্যতম শত্রু। সম্ভবতঃ এই মুহূর্তে ওদের বন্দুকের সীমানার মধ্যে আমরা দু’জনা রয়েছি। এই সুযোগে আমাদের গুলি করে মেরেও তো দিতে পারে। জবাবে আমি বলেছিলাম, এমন প্রকাশ্যে ওরা আমাদের মারবে না। শেখ হাসিনার death squad আমার রিমান্ডকালে ক্যান্টনমেন্ট থানায় গভীর রাতে প্রবেশ করেও আমাকে একেবারে শেষ করে দেয়নি। ওরা নীরব ঘাতক। সুযোগ বুঝে এমনভাবে মারবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। অর্থাত্ মারবে, তবে প্রমাণ রাখবে না। একই গাড়িতে চলতে চলতে সহযাত্রী ড্যাব নেতা ডা. জাহিদ হোসেন এবং কবি আবদুল হাই শিকদার আমাদের কথা শুনে যথেষ্ট উদ্বেগ সহকারে মন্তব্য করেছিলেন, আপনাদের সাবধানে চলাচল করা দরকার। দেশ ও জাতির শত্রুরা কেমন করে ঢাকার রাজপথ থেকে ইলিয়াসকে উঠিয়ে নিয়ে গে ছে, জানি না। ও এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে তাও সম্ভবত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং বিশেষ বাহিনীতে তার বিশ্বস্ত গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে ওপর থেকে অবশ্যই শেষ বিচারের মালিক মহান আল্লাহ্ সবকিছু দেখছেন। ইলিয়াসের মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ আপনজন এবং আমাদের মতো শুভানুধ্যায়ীরা আজও তার পথচেয়ে আছে। আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি, এই সরকারের সুমতি হোক, ইলিয়াসসহ সব গুম করা ব্যক্তিকে আপনজনের কাছে সত্বর জীবিত ফিরিয়ে দিক। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বিনীত শাসকশ্রেণী বর্তমানে দেশটি শাসন করছে। এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে লেশমাত্র বিবেক, নীতি অথবা লজ্জাবোধ আর অবশিষ্ট নেই। ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকবৃন্দ যে ধরনের উদ্ধত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, তার মধ্য থেকেই এদের সার্বিক দেউলিয়াপনা প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবীরা দেশের ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে নিম্নশ্রেণীর চাটুকারিতার স্বাক্ষর রেখে প্রধানমন্ত্রীকে তথাকথিত সমুদ্র বিজয়ের জন্য গণসংবর্ধনা দিয়ে টাকা ও রুচির শ্রাদ্ধ করেছেন। সেই অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক মানপত্র পাঠ করেছেন। এই ভদ্রলোকের কবিতা যে অতি উচ্চমানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় তার লেখা ‘ঢাকায় প্রথম বসতি’ কবিতাটা যে কতবার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। আমি পুরনো ঢাকায় বড় হয়েছি। এই কবিতায় চেনা সব জায়গার অসাধারণ কাব্যিক বর্ণনা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মনটাকে বড় উদাস করে দিত। চোখে পানি চলে আসত। তবে উন্নত সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ হকের ব্যক্তি চরিত্র কতখানি নিম্নমানের, সেটা জানার জন্য চিন্তা-চেতনায় তারই স্বগোত্রীয়, দীর্ঘদিন ধরে ভারতমাতার কোলে ঠাঁই নেয়া তসলিমা নাসরিনের বই পাঠ করলেই চলবে। কাজেই আবদুল হাই শিকদারের ভাষায় তার কদমবুসি আচরণে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে শেখ হাসিনার সেই সংবর্ধনায় অশীতিপর শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং প্রবীণ দক্ষ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের নিম্নরুচির চাটুকারিতা আমাদের প্রচণ্ড রকম বেদনাহত করেছে। সেই ছাত্রজীবন থেকে এদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বড়াই শুনতে শুনতে আমরাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেছি। বুঝতে পারি না এই ব্যক্তিদের আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে যে এতটা নিচে নামত ে হবে। সারাদেশ যখন গুম-খুনের আতঙ্কে ম্রিয়মাণ হয়ে রয়েছে, তখন তাদের আয়োজিত সংবর্ধনায় শাসকদের প্রতি তোষামোদি বাক্য শুনে বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের মনে ঘৃণাপ্রসূত বমনেচ্ছার উদ্রেক হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে তারা ভুলেও ইলিয়াসের নামটাও উচ্চারণ করেননি। বিদ্বানের চাটুকারিতা প্রসঙ্গে আমাদের মহানবীর একটি সুবিখ্যাত হাদিস রয়েছে, যেটি পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ইরানি সুফি জালালউদ্দিন রুমি তার লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন। হাদিসটি আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু অনূদিত মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী’র সংলাপ থেকে উদ্ধৃত করছি : রুমী উল্লেখ করেছেন, ‘‘মহানবী মুহাম্মদ (সা.) একবার বলেছেন, ওইসব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সবচেয়ে অধঃপতিত, যারা বাদশাহদের সাথে সাক্ষাত্ করতে যায় আর সর্বোত্তম বাদশাহ তারাই, যারা বিজ্ঞজনের সাথে সাক্ষাত্ করে। জ্ঞানী বাদশাহ তিনিই, যিনি দরিদ্রের দ্বারে গিয়ে দাঁড়ান, আর অধঃপতিত দরিদ্র তারাই যারা বাদশাহর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।” মেঘে মেঘে তো বেলা কম হলো না। এবার ইহজাগতিকতা বাদ রেখে একটু পরকালের কথা ভাবলে হতো না! অবশ্য এ দেশের আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ক’জন প্রকৃতই পরকালে বিশ্বাস রাখেন, সেটা নিয়ে আমার মনে অন্তত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যারা ইহজগতকেই একমাত্র মোক্ষ বিবেচনা করেন, তারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট খোঁজার কাজে ব্যাপৃত থাকবেন এতে আর আশ্চর্য কী? ক্ষোভে-দুঃখে বিষয়ের খানিক পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড অহমিকা ও বলদর্পী ফ্যাসিবাদী আচরণের কথা লিখতে গিয়ে বশংবদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে চলে গেছিলাম। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা এবং তার মহাজোট মার্কিন ও ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কী কারণে এই আশীর্বাদ তার পায়ের তলায় তখন গড়াগড়ি খেয়েছিল, সে সম্পর্কে গত সাড়ে তিন বছরের লেখালেখিতে যথাসম্ভব বিচার- বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। আজ আর পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটে বর্তমান পরিস্থিতির ওপরই কেবল দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছি। কাছের ও দূরের সাম্রাজ্যবাদের আশকারায় ক্ষমতাসীন মহল তাদের এবারের মেয়াদে একদিকে যেমন সুশাসন নির্বাসনে পাঠিয়ে দুর্নীতির মহোত্সব বসিয়েছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখিয় ে সকল প্রকার ভিন্নমত দমনের উদ্দেশ্যে সরাসরি ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা-গুম চলছে, এমনকি পশ্চিমাদের অতি কাছের সুশীলদের (?) পর্যন্ত এরা ছেড়ে কথা কয়নি। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস গ্রেফতার ও রিমান্ড থেকে বেঁচেছেন বটে, কিন্তু তাকে যে প্রক্রিয়ায় ও পরিমাণে হেনস্থা করা হয়েছে, তা নিয়ে রীতিমত একখানা মহাভারত রচনা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অতি প্রভাবশালী ক্লি নটন পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধুকে চূড়ান্ত অপমান করার স্পর্ধা গণতন্ত্রের কথিত মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে কাকতালীয়ভাবে মার্ক িনিরাই সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশে এক বায়বীয় ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, তার তাবত্ অপকর্ম তিনি জায়েজ করতে সক্ষম হবেন। বছর তিনেক পর্যন্ত তার কৌশল যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর, হালে মনে হচ্ছে তিনি লক্ষণরেখা অব শেষে অতিক্রম করেই ফেলেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর অতি সাম্প্রতিক যৌথ সফর তার জন্য অশনি সঙ্কেতই বহন করে এনেছে। বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের স্বৈরশাসন বিনাবাক্যে সহ্য করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র, দুর্নীতি, সুশাসন, মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। একই সময়ে প্রণব মুখার্জির বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং সেই সাক্ষাতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব ও আগামী নির্বাচন বিষয়ে তার বক্তব্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ভারতের অর্থমন্ত্রীর এটা তৃতীয় বাংলাদেশ সফর। আগের দু’বারে তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতেরও সময় করে উঠতে পারেননি। এবার তিনি কেবল সাক্ষাত্ই করেননি, অনেকটা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ভারত বাংলাদেশে কোনোরকম একতরফা নির্বাচন চায় না। তাছাড়া, প্রথম বারের মতো তিনি এ দেশের কোনো একটি বিশেষ দলের পরিবর্তে জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর অবস্থানের প্রকৃতই যদি পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাহলে উপমহাদেশে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শান্তি স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাসমূহের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ভারতীয় হাইকমিশন আমার দেশসহ ছয়টি বিশেষ পত্রিকার সম্পাদককে আমন্ত্রণ তালিকার বাইরে রেখে তাদের আধিপত্যবাদী, অসহিষ্ণু চরিত্রকেই পুনর্বার উন্মোচিত করেছে। হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দীপু মনি এবং শেখ হাসিনার বৈঠকের সময়ও আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিককে খবর সংগ্রহের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশা করি, এটুকু মানবেন যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো হলেও সর্বাধিক আলোচিত কিন্তু আমার দেশই। যাই হোক, প্রণব মুখার্জীর কথা ও কাজে মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের বেশকিছু কাল আরও অপেক্ষা করতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের নতুন সুর এ দেশের জনগণকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে। সব মিলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলের জন্য হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব মুখার্জীর সফর যে আনন্দদায়ক হয়নি, সেটি বাগাড়ম্বর প্রিয় মহাজোট মন্ত্রীদের আপাত নীরবতা থেকে কিছুটা বোধগম্য হচ্ছে। ইলিয়াস আলীকে গুম এবং বিরোধীদলের প্রায় তিন ডজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের করে শেখ হাসিনার সরকার ভিন্ন মতকে আতঙ্কগ্রস্ত করে কোণঠাসা করার যে আয়োজন করেছিল, সেটাও বুমেরাং হয়ে তাদেরই আঘাত করেছে। হিলারি ক্লিনটন গুমের পর নিহত আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং ইলিয়াস আলীর নাম তার বিভিন্ন বক্তব্যে বারংবার উল্লেখ করে সম্ভবত সরকারকে এক প্রকার সতর্ক বার্তা দিতে চেয়েছেন। গণতন্ত্রের নামে এভাবে গুম-খুনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর প্রশ্রয় দেবে না বলেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এমতাবস্থায়, শেখ হাসিনার উচিত হবে আর সময় ক্ষেপণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তা ন্তরের উপায় খুঁজে বের করার জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আন্তরিক সংলাপে বসা। প্রধানমন্ত্রীর তিন দশকের রাজনীতি এবং দুই দফায় সাড়ে আট বছরের শাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের পর লিখতে বসে শেক্সিপয়রের অসাধারণ এক উক্তির কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে— “Vengeance is in my heart, death in my hand, blood and revenge are hammering in my head”. শেক্সিপয়র বর্ণিত সেই অসুস্থ রাজনীতি অব্যাহত রাখার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ইচ্ছা পূরণ বর্তমান ভূ- রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্ভব হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০০৭ সালে বিএনপির পক্ষে একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এবার পেশিশক্তি ও মার্কিন- ভারত একতরফা সমর্থনের জোরে শেখ হাসিনা সেই গর্হিত কাজটি করে ফেলতে পারবেন, এমন বিকৃত চিন্তা দেশে অবধারিত রক্তক্ষয়ী বিবাদের সূচনা করবে। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কারও জন্যই সুখকর হবে না। প্রতিহিংসা কেবল প্রতিহিংসারই জন্ম দেবে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা একবাক্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রীও প্রকারান্তরে একই বারতা দিয়ে গেলেন। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনেক আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপিরা অবশ্য জনরোষের ভয়ে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধিতা করে চলেছেন। এবার অহমিকা ত্যাগ করে শেখ হাসিনার বাস্তবতা উপলব্ধির পালা। অন্যথায় দেশে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করার সকল দায় তাকেই নিতে হবে। লেখার শুরুতে ঢাকা বিমানবন্দরে বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেই ঘটনা বিবৃত করেই আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনে সমাপ্তি টানব। ৪ তারিখ সকালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিমানে দেশে ফিরে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছি, এমন সময় এসবির একজন কর্মকর্তা এসে আমার পাসপোর্ট নিয়ে আগমন হলের এক কোণে বসতে দিলেন। শুরু হলো প্রতীক্ষা। একে একে সব যাত্রী চলে যাচ্ছে। আমার স্ত্রীও ইমিগ্রেশনের বাধা পার হয়ে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল। আধ ঘণ্টাখানেক পরে খবর পেলাম তিনি লাগেজ সংগ্রহ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কানাঘুষায় শুনলাম আমার নামে নতুন মামলা হয়েছে কিনা, কিংবা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হবে কিনা, এসব নিয়ে বিভিন্ন এজেন্সিতে খোঁজ-খবর নেয়া চলছে। একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললাম, গ্রেফতারের ভয় পেলে তো বিদেশেই থেকে যেতে পারতাম! বেচারা নিম্নস্তরের কর্মকর্তা। সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। শেষ পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক বাদে স্বদেশে ঢোকার ছাড়পত্র মিলল। এতদিন সরকারের আমাকে বাইরে যেতে দিতে আপত্ত ি ছিল। এবার মনে হলো ক্ষমতাসীন মহল আমাকে দেশে ফিরতে দিতে অনিচ্ছু ক। পরবর্তী অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় রইলাম। ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

No comments:

Post a Comment